কক্সবাজারে পাহাড় ধস আতঙ্ক, যেকোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে প্রাণহানি

সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার •

শুক্রবার (৪ জুন) রাত থেকে থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। শনিবার রাত ও রবিবার ভোররাত থেকে বৃষ্টিপাত বেড়েছে। এতে প্লাবিত হচ্ছে শহর ও গ্রামের নিম্নাঞ্চল। অনেক জায়গায় ডুবছে চলাচলের পথও।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ঝুপড়ি ও গ্রামের অনেক কাঁচা বাড়ি-ঘর বাতাসের ঝাপটায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দায়িত্বশীলরা। চরম দূর্ভোগে পড়েছে হতদরিদ্র ও পানি নিমজ্জিত এলাকার লোকজন।

ভারি বর্ষণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড় ধসে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে শনিবার। এরপর থেকে বর্ষণ অব্যাহত থাকায় কক্সবাজার শহরের পাহাড়ী এলাকাসহ জেলার প্রতিটি পাহাড়ী এলাকায় পাহাড় ধস আতংক বিরাজ করছে। এমন দুর্যোগে প্রাণহানি রোধে পাহাড় কেটে আবাস গড়া ঝুঁকিতে বাসকারীদের নিরাপদে সরে যেতে মাইকিং করছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা লোকজনদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে সরে যেতে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে মাইকিংয়ে। ঝুঁকি এড়াতে নিরাপদ আশ্রয়ে আসতে চাওয়া লোকজনের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে একাধিক আশ্রয় কেন্দ্র।

স্থানীয়রা জানায়, গত কয়েকদিনের ভারীবর্ষণ ও ঝড়ো বাতাসে জেলা শহরসহ বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড় ধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে পাহাড় ধস ও প্রাণহানির ঘটনা। এ আশঙ্কায় পাহাড়ের পাদদেশ বা চুঁড়ায় ঝুঁকিপূর্ণ আবাস গড়া লোকজনদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে সরে যেতে নির্দেশ দিয়ে মাইকিং হয়েছে। স্বেচ্ছায় না সরলে অভিযানের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারিও দেয়া হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানাযায়, কক্সবাজার শহরের মোহাজের পাড়া, বৈদ্যঘোনা, লাইটহাউজ পাড়া, সমিতিপাড়া, ঘোনারপাড়া, পাহাড়তলী, বর্মাইয়া পাড়া, এবিসি ঘোনা, টেকনাইফ্ফা পাহাড়, সিটি কলেজ এলাকা, নতুন জেলখানা, ডিগকুল বিজিবি ক্যাম্প, মহুরিপাড়া, কক্সবাজার সদর উপজেলার ঈদগাঁও, খুরুশকুল, পিএমখালী, ভারুয়াখালী, রামুর খুনিয়াপালং, দক্ষিণ মিঠাছড়ি, জোয়ারিয়ানালা, ঈদগড়, গর্জনিয়া, উখিয়ার রাজাপালং, হলদিয়াপালং, পালংখালী, টেকনাফের হোয়াইক্যং, বাহারছড়া, হ্নীলা, টেকনাফ সদর ইউনিয়ন, চকরিয়ার খুটাখালী, বরইতলী, ডুলাহাজারা, হারবাং, পেকুয়ার বারবাকিয়া, টৈটং, পহঁরচাদা, মহেশখালীর কালারমারছরা, হোয়ানক, ছোটমহেশখালী, শামলাপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় কেটে বসবাস করছে সহস্রাধিক পরিবার। এসব এলাকায় প্রায় পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন হওয়ার অভিযোগ আসে। টানা বৃষ্টিতে ক্ষতবিক্ষত পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে ধসে পড়ে। এতে ঘটে অনাকাংখিত মৃত্যুর ঘটনা।

কক্সবাজার জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, জেলায় ৫২ স্পটে ৮৯৮ পরবিার ঝুঁকিতে রয়েছে। কক্সবাজার পৌরসভায় ঘোনারপাড়া, বৈদ্যঘোনা, মোহাজেরপাড়াসহ পাহাড় বেস্টিত এলাকায় ঝুঁকিতে থাকা পৌরসভায় ঝুঁকিপূর্ণ ৬টি ওয়ার্ডে ৭টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে ঝুঁকি থাকাদের জোর করে হলেও আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নেয়া হবে। বিশেষ করে বয়স্ক নারী-পুরুষ, শিশু, গর্ভবতিদের আগেভাগে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা প্রশাসন। যারা আশ্রয় কেন্দ্রে আসবেন তাদের জন্য পর্যপ্ত খাবার মজুদ রাখা হয়েছে।

অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. আবু সুফিয়ান বলেন, কক্সবাজার পৌরসভার অভ্যন্তরে ৬টি ওয়ার্ডে সবচেয়ে বেশি মানুষ ঝুঁকিতে বাস করছে। তাদের সরিয়ে আনাটা একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। তারপরও ঝুঁকি এড়াতে কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে জেলা প্রশাসন। রবিবার (৬ জুন) দুপুরে এ সংক্রান্ত একটি জরুরি মিটিং হয়েছে। মিটিং-এ সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের প্রধান করে একটি উপকমিটিও গঠন করা হয়। তালিকা প্রণয়নে কাজ করা এনজিও সংস্থাও সহযোগি হিসেবে কাজ করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

এডিএম আরো বলেন, চলমান সময়ে কি পরিমাণ মানুষ ঝুঁকিতে বাস করছে তার সঠিক কোন তালিকা তৈরী করা যায়নি। তবে, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা পর্যবেক্ষণ করে ঝঁকিতে থাকা পরিবারের তালিকা তৈরি করতে দায়িত্বপালন করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) মুক্তি কক্সবাজার, পালস্, ইপসা, গ্রীণকক্স, নোঙ্গর, এক্সপাউরুল, নেকম, হেলফ, কোস্ট ট্রাস এবং ওয়াল্ডভিশন। এসব সংস্থাগুলো দুর্যোগকালীণ সময়েও প্রশাসনকে সহযোগিতা করবে। অনাকাংখিত মৃত্যু এড়াতে কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা প্রশাসন।

এদিকে, অতিবর্ষণে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড় ধসে নারীসহ দুজনের মৃত্যু হয়েছে। শনিবার (৫ জুন) টেকনাফের চাকমারকুল ও উখিয়ার বালুখালী ময়নারঘোনা ক্যাম্পে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন, টেকনাফের চাকমারকুল রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শাকের আহমেদের স্ত্রী নুর হাসিনা (২০) ও উখিয়ার বালুখালী ময়নারঘোনা ক্যাম্পের মৃত অছিউর রহমানের ছেলে রহিম উল্লাহ (৩৫)। এ ঘটনার পর থেকে পাহাড়ের পাদদেশ ও চুঁড়ায় বসবাসকারি পরিবারগুলোতে আতংক বিরাজ করছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে পাহাড় ধসে আশংকা রয়েছে।

ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারের তালিকা তৈরিতে দায়িত্বপ্রাপ্তদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বৃষ্টি শুরু হলে প্রতিবছর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু বর্ষা শেষ হওয়ার আগেই তা কাগজে কলমে ফাইল বন্দি থাকে। যার ফলে ঝুঁকিতে থাকাদের সরিয়ে নেওয়া তো দূরের কথা, উল্টো পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণ বৃদ্ধি পায়। তবে, যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা চলমান রেখে কাজ শেষ করা গেলে পাহাড় ধসের মৃত্যু এড়ানো সম্ভব।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, অতীতে কি হয়েছে সেটি বলতে পারবো না। আমি কাজ করতে চাই। তালিকা সম্পন্ন হলে ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে সরানো হবেই। কেউ না যেতে চাইলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেয়া হবে। তবে, যেকোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবিলায় ফায়ার সার্ভিস, রেড ক্রিসেন্টসহ নানা সংস্থাকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রয়োজনে সহযোগিতা নেয়া হবে সেনাবাহিনীরও।